পরমাণুরবাদের প্রথমিক ধারণা :-
অজানাকে জানার ইচ্ছা মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের একটি চিরন্তন ধারা। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪০ অব্দে বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক লুসিপাস ও ডেমোক্রিটাস সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন, সব পদার্থই অতি ক্ষুদ্র এক ধরনের অবিভাজ্য অসংখ্য কণা দিয়ে তৈরি । প্রায় একই সময়ে ভারতের প্রখ্যাত দার্শনিক কণাদ প্রায় একই ধরনের মতবাদ উপস্থাপন করেন । তিনি প্রস্তাব করেন যে, প্রাকৃতিক সব বস্তুই অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণু নামক অবিভাজ্য কণার সমন্বয়ে গঠিত।
প্রায় ১০০ বছর পর বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিন্টাটল প্রস্তাব করেন, পদার্থ অবিভাজ্য কণার সমষ্টি নয়। সব পার্থিব বস্তুই অবিচ্ছিন্ন পদার্থ দিয়ে গঠিত। অ্যারিস্টাটলের এ মতবাদ প্রায় ২০০০ বছর ব্যাপি প্রচলিত ছিল। পরে আঠার শতকের প্রথম দিকে বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন কর্তৃক পদার্থের গঠন প্রস্তাবিত তত্ত¡ ডেমোক্রিটাসের পরমাণুবাদকে পুনরাই সমর্থন করেন । উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ১৮০৩ সালে ব্রিটিশ স্কুল শিক্ষক ও বিজ্ঞানী জন ডাল্টন তার পরমাণুবাদে ডেমোক্রিটাস ও কণাদ এর পরমাণুবাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন । ডাল্টনের মতবাদ অনুসারে পরমাণু অবিভাজ্য, একে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। অবশেষে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ১৯১১ সালে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড তার বিখ্যাত আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত রুপে প্রমাণ করেন যে, পরমাণু বিভাজ্য। পরমাণু বিশেষ কতগুলো কণিকার সম্বনয়ে গঠিত। পরমাণুকে বিভাজিত করলে ইলেকট্রন, প্রোটন, ও নিউট্রন প্রভূতি মূল কণিকা পাওয়া যায়। ১৯১৩ সালে বিজ্ঞানী বোর রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের আরও উৎকর্ষ সাধন করেন।
পরমানু ও পরমাণুর মৌল কণিকাসমূহ :
মৌলিক পদার্থেও ক্ষুদ্রতম কণা সাধারণত যার স্বাধীন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু ক্ষুদ্রতম একক রুপে সরাসরি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহন করতে পারে , তাকে পরমাণু বলে। প্রত্যেক মৌলের প্রতীক দ্বারা ঐ মৌলের পরমাণুকে বুঝানো হয়। যেমন :ঐ দ্বারা হাইড্রোজেনের পমাণু বুঝায়।
পরমাণুসমূহকে বিভিন্ন ভাবে ভেঙ্গে যে সব কণা আবিষ্কিত হয়েছে মোটামুটি ভাবে তাদেরকে পরমাণুর মূল কাণিকা বলা হয়। অবশ্য অন্যভাবেও কিছু কিছু কণার সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। তাদের সংখ্যা প্রায় ২০০ এর মত এবং এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। মূল উপাদানরূপ যে সব অতি সূক্ষ কণিকা দ্বারা পরমাণু গঠিত তাদের কে পরমাণুর মূল কণিকা বলে।
মূল কণিকা দুই প্রকার । যথা :
১. স্থায়ী মূল কণিকা ও
২.অস্থায়ী মূল কণিকা ।
১. স্থায়ী মূল কণিকা : যে সব অতি মূল কণিকা সব মৌলের পরমাণুতে থাকে, তাদেরকে স্থায়ী মূল কণিকা ।
স্থায়ী মূল কণিকা তিন প্রকার । যথা :
ক. ইলেকট্রন
খ. প্রোটন
গ. নিউট্রন
২.অস্থায়ী মূল কণিকা : যে সব মূল কণিকা কোন কোন মৌলের পরমাণুতে অতি অল্প সময়ের জন্য অস্থায়ীভাবে থাকে, তাদের কে অস্থায়ী মূল কণিকা বলে।
অস্থায়ী কণিকার কয়েকটি হচ্ছে ; (ক) পাইওন (খ) মিউওন (গ) নিউট্রিনো ও (ঘ) মেসন প্রভূতি । অস্থায়ী কণিকাগুলো সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে অন্য কণায় পরিণত হয়।
স্থায়ী কণিকা :
ক. ইলেকট্রন ((থ-১^০)ব) : ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে স্যার জে. জে. থমসন ক্যাথোড রশ্মির উপর পরীক্ষার সময় ইলেকট্রনের অস্থিত্ব আবিষ্কার করেন। সব প্রকার পরমাণুতে কম বেশি ইলেকট্রন বিদ্যমান। পদার্থের মধ্যে ইলেকট্রন সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্রতম কণা।
ইলেকট্রন আবিষ্কার : তড়িৎ বা চৌম্বকক্ষেত্রে এদেও বিক্ষেপনের ধরন থেকে জে. জে. থমসন এই কণাগুলোকে ঋণাত্মক বলে প্রমাণ করেন । এই ঋণাত্মক বিদুৎবাহী কণাগুলো ইলেকট্রন নামে পরিচিত।
লঘু চাপে (0.1 – 0.001 mm (Hg) একটি কাচের আবদ্ধ পাত্রে কোন গ্যাস নিয়ে এর ভিতরে দুটি তড়িৎদ্বার প্রবেশ করিয়ে যতেষ্ঠ বিদ্যুত বিভব প্রয়োগ করলে তড়িৎদ্বার দুইটির ভিতর বিদ্যুৎক্ষরণ হতে থাকে এবং ক্যাথোড হতে সোজাসোজি আলোক রশ্মি বের হয়। কোন বাধা না থাকলে এই রশ্মি ক্যাথোড হতে অ্যানোডের দিকে প্রবাহমান থেকে অ্যানোডের পিছনে কাচের উপর পতিত হয়ে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে। এরাই ক্যাথোড রশ্মি। আবার যদি পাত্রকে কোন তড়িৎ ক্ষেত্রে এমনভাবে বসানো হয় যাতে ক্যাথোড রশ্মির প্রবাহ পথের এক পাশে দ্বিতীয় আরেকটি তড়িৎ ক্ষেত্রের ধনাত্মাক (অ্যানোড) তড়িৎদ্বার ও অপর পাশে ঋনাত্মক তড়িৎদ্বার (ক্যাথোড) থাকে তাহলে দেখা যায় প্রবাহমান এই রশ্মি নিজের পথ থেকে ধনাত্মাক তড়িৎদ্বারের (অ্যানোড) দিকে বেঁকে যায়। এতে বুঝা যায় এই রশ্মি ঋনাত্মক আধানের ক্ষুদ্র প্রবাহ।
ক্যাথোড রশ্মিতে উৎপন্ন ইলেকট্রনগুলো মুক্ত ও সর্বদাই একই প্রকার। যে কোন গ্যাস থেকে একই ইলেকট্রন রশ্মি বের হয় এবং এরা ক্যাথোডের প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল নয়। অথাৎ পরীক্ষার সাহয্যে জানা গেছে যে, যে কোন উপায়ে যে কোন উৎস থেকে প্রাপ্ত ও যে কোনো গতিবেগ সম্পন্ন সব ইলেকট্রন একই রকম, একই চার্জ (-1.610-19 C) যুক্ত ও একই ভর (9.108510-28 g) বিশিষ্ট।
প্রোটন ((থ১^১)চ) : ইলেকট্রনের মত প্রোটনও সব পদর্থের পরমাণুর একটি সাধারন উপাদান। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড এ তথ্য সর্ব প্রথম প্রমাণ করেন। প্রোটন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে বিদ্যমান সর্বাপেক্ষ হালকা ধনাত্মক চার্জ বিশিষ্ট একটি স্থায়ী কণা।
প্রোটন আবিষ্কার : ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী গোল্ডস্টাইন ক্যাথোড রশ্মি নল পরীক্ষা দ্বারা ধনাত্মক আয়ন আবিষ্কার করেন। ক্যাথোড রশ্মি যন্ত্রে সচ্ছিদ্র ক্যাথোড ব্যবহার কার হয় তাহলে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ক্যাথোড হতে অ্যানোডের দিকে ক্যাথোড রশ্মির মত এক বিপরীত মূখী রশ্মি অ্যানোড হতে ক্যাথোডের দিকে সঞ্চালিত হয়ে ক্যাথোডের ছিদ্র পথে নির্গত হয়ে ক্যাথোড তড়িৎদ্বাড়ের পিছনে কাচের দেওয়ালে দীপ্তিমান (প্রতি প্রভা সৃষ্টির মাধ্যমে ) করে তুলে। এ রশ্মিকে অ্যানোড রশ্মি বা ধনাত্মক বশ্মি বা ক্যানাল রশ্মি।
আবার যদি পাত্রকে কোন তড়িৎ ক্ষেত্রে এমনভাবে বসানো হয় যাতে অ্যানোড রশ্মির প্রবাহ পথের এক পাশে দ্বিতীয় আরেকটি তড়িৎ ক্ষেত্রের ধনাত্মাক (অ্যানোড) তড়িৎদ্বার ও অপর পাশে ঋনাত্মক তড়িৎদ্বার (ক্যাথোড) থাকে তাহলে দেখা যায় প্রবাহমান এই রশ্মি নিজের পথ থেকে ঋনাত্মক তড়িৎদ্বারের (ক্যাথোড) দিকে বেঁকে যায়। এতে বুঝা যায় এই রশ্মি ধনাত্মাক আধানের ক্ষুদ্র প্রবাহ।
বিভিন্ন গ্যাসীয় পরমানু থেকে উদ্ভত এই ধনাত্মাক বিদ্যুৎ ধর্মী কণা গুলো বিভিন্ন। এদের ধনাত্মাক বিদ্যুৎ মাত্র এক হলেও এদের ভর এক নয়। বিভিন্ন গ্যাস নিয়ে পরীক্ষা দেখা যায় হাইড্রোজেন গ্যাস থেকে উৎপন্ন ধনাত্মাক বিদ্যুত বাহী কণা সবচেয়ে হালকা। একেই প্রোটন বলে। সব ধনাত্মাক বিদ্যুৎ ধর্মী কণার ভর মোটামুটি একটি প্রোটোনের চার্জ ইলেকট্রনের চার্জেও সমান, কিন্তু বিপরীত ধর্মী অথাৎ ধনাত্মাক বিদ্যুৎ ধর্মী।
প্রোটনের চার্জ (+1.610-19 C) ও ভর (1.67210-24 g) ।
নিউট্রন ((থ০^১)হ) : ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড পরমাণুর মধ্যে চার্জ বিহীন ও প্রোটনের মত এক একক ভর বিশিষ্ট এক ধরনের মূল কণিকার অস্তিত্ব কল্পনা করেন। কারণ দেখা গেছে, কোন পরমাণুতে উপস্থিত চার্জ যুক্ত প্রোটন এবং ঋনাত্মক চার্জ যুক্ত ইলেকট্রনের মোট ভরের চেয়ে পরমাণুর মোট ভর বা পারমাণবিক ভর বেশি। পরবর্তিতে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী জেমস চ্যাডউইক মূল কণিকা হিসাবে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রনের উপস্থিতি প্রমাণ করেন।